জিডিপি, জিএনপি এবং মাথাপিছু আয় ইত্যাদি হিসাবগুলোতে যে সমস্ত শ্রম বাজারে বিক্রি করা হয় না সেগুলোকে ধরা হয় না। ফলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর শ্রম জাতীয় আয়ের অংশ হিসাবে মর্যাদা পায় না যা প্রকারান্তরে মানুষে মানুষে অসমতা সৃষ্টি করে। যেমন, গৃহস্থালি দৈনন্দিন কাজে নারীরা যে শ্রম দেয় তা হিসাবের মধ্যে না নেওয়ায় একদিকে যেমন মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় না, অন্যদিকে তা গৃহস্থালি কাজে নারীর শ্রমকে মূল্যহীন করে তোলে।
উপরোক্ত সমস্যাসহ আরও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে একটি দেশের মানুষ প্রকৃত বিচারে কেমন আছে তা জানার জন্য ব্যবহার হচ্ছে ‘মানব উন্নয়ন সূচক' (Human Development Index) ধারণা। এখানে নানান সূচক ব্যবহার করে দেখা হয় যে, একটি দেশের অর্থনীতি কতটা কল্যাণমুখী । কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সূচক হচ্ছে গড় আয়ু, গড় সামাজিক অসমতা, প্রসবকালীন মৃত্যুর হার, বেকারত্বের হার, দারিদ্র্যের হার, শিশুশ্রমের হার, কর্মহীন ও সামাজিকভাবে অসহায় হত-দরিদ্রের হার, বাল্যবিবাহের হার, বাল্য মাতৃত্বের হার, আয়ের বৈষম্যের হার, সাক্ষরতার হার, পরিবেশ বান্ধব টেকসই উন্নয়ন ইত্যাদি।
কোনো দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান কেমন তা বোঝার জন্য এ সংক্রান্ত কিছু নির্ধারক তথ্য প্রয়োজন যাকে সেগুলোর মানব উন্নয়নের সূচক বলা হয়। যেমন, জনগণের সাক্ষরতার হার কতো, ছাত্রভর্তির সংখ্যা বা হার কতো, তাদের আয় কতো, ব্যয় কতো, তারা কেমন বাড়ি ও চিকিৎসা পাচ্ছে, তাদের খাদ্য গ্রহণের অবস্থা কেমন ইত্যাদি । এ ধরনের বেশ কিছু সূচককে একত্রিত করে বলা হয় ঐ দেশ বা জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার মান কেমন।
মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা
বর্তমানে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, মোট জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানব সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে আর্থ-সামাজিক খাতে বাজেটের ২০% বেশি ব্যয় করছে। ২০২০ সালের Human Development Report মোতাবেক মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩ তম যা ২০১৪ সালে ছিল ১৪২ তম। সরকার শিক্ষার সকল স্তরে সমান সুযোগ সৃষ্টি ও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির মাধ্যমে দক্ষ ও যোগ্য মানব সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়নসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০% মহিলা শিক্ষক নিয়োগের বিধি প্রবর্তনের ফলে মহিলা শিক্ষকের হার ১৯৯১ সালের ২১% থেকে বর্তমানে ৬৪.৯% উন্নীত হয়েছে। এছাড়া সরকার স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় প্রজনন হার ও মৃত্যু হার কমেছে, গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে, নবজাত শিশু ও মাতৃ-মৃত্যু হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে, অপুষ্টির হার হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশে ২০১৬ সালে পরিচালিত সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে আয়ভিত্তিক দারিদ্র্যের হার ৩১.৫ শতাংশ থেকে ২৪.৩ শতাংশে নেমে আসে। অপরদিকে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আয়ভিত্তিক দারিদ্র্যের হার ৪০.০ শতাংশ থেকে ৩১.৫ শতাংশে নেমে আসে। (উৎস: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা- ২০২০ )
সরকার গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি আনয়নের লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা এবং হত-দরিদ্র বিশেষ করে বয়স্ক, দুঃস্থ নারী, প্রতিবন্ধী, এতিমসহ আরও অনেককে নগদ ভাতা ও বিনামূল্যে খাদ্য প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করছে। এর পাশাপাশি একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রয়ণ, গৃহায়ণ ইত্যাদি প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনায় উক্ত অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন ও সফলভাবে বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বীকৃতি পেয়েছে। মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এ ৩টি সূচকের যে কোনো দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে। উন্নয়নশীল কয়েকটি দেশের সাথে মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে বাংলাদেশের তুলনা করলেই আমরা এই অর্জনের যথার্থতা অনুধাবন করতে পারব।
কাজ : মানব উন্নয়ন সূচকের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ণয় করো।
Read more